সোমবার, ২৭ জুন, ২০১৬

আগর চাষে শতকোটি টাকার বৈদেশিক আয়ের সম্ভবনা || জানেন আগর গাছ কি!!



ডেস্ক: একটা সময় ছিলো যখন সারা পৃথিবীতেই বাংলাদেশ ছিলো সুগন্ধি আগর চাষের জন্য বিখ্যাত। বৃহত্তর সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চল ছিলো আগর গাছে সমৃদ্ধ। বিদেশি ব্যবসায়িরা এসব আগর সংগ্রহ করে পাঠাতো আরব-ইউরোপে।
সুগন্ধি উপাদান হিসেবে আরব শেখ আর ইউরোপীয়দের মাঝে ব্যাপক চাহিদা ছিলো সিলেটের আগরের।
কিন্তু আগরের সেই দিন আর নেই। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আর অবহেলায় সিলেটের বনাঞ্চল থেকে আগর গাছ বর্তমানে বিলুপ্ত প্রায়। অথচ একটু মনোযোগ দিলেই এই আগর চাষ থেকে সম্ভব শত কোটি টাকার বৈদেশিক আয়।
আগর গাছ একটি ঔষধী গাছ। আগর চাষের জন্য বাংলাদেশের আবহাওয়া খুবই উপযোগী। আগরের তেল, বাকল, আগরবাতি ও সুগন্ধি খুবই উপকারী।

সিলেটের বনাঞ্চল থেকে আগর গাছ হারিয়ে যাওয়ার পথে হলেও এখনও মৌলভীবাজারের বড়লেখায় আগরের তেল উৎপাদিত হয়। জানা গেছে, বছরে উৎপাদিত হয় মাত্র ১ হাজার ৫শ‘ লিটার তেল।

আগর কাঠের অভাবে বর্তমানে আগর কারখানাগুলো বছরে ৬ থেকে ৭ মাসের বেশি উৎপাদন কার্যক্রম চালাতে পারছে না।
সম্প্রতি বাংলাদেশে আগর চাষের সম্ভাবনা ও সমস্যা নিয়ে সেমিনার অনুষ্ঠিত হয় রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে। সেখানে তুলে ধরা হয় আগর চাষ ও আগর শিল্পের সম্ভাবনার নানা দিক।

আগর গাছ হতে পারে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম খাত। এ ব্যাপারে প্রধান বন সংরক্ষক ইউনুছ আলী বলেন, আগর গাছ থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। এজন্য আগর থেকে মানসম্মত পণ্য উৎপাদন করে বিদেশে রফতানি করতে হবে।
তবে বাংলাদেশ থেকে আগর গাছ বিলুপ্তপ্রায় হওয়ার পেছনে অন্যতম দায়ী হলো এর ক্ষয়ে যাওয়া রোগ। এই রোগের প্রতিকার খুঁজে বের করতে আগর রক্ষায় গবেষণার ওপর জোর দেন পরিবেশ ও বন সচিব কামাল উদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, আগর আমাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী বনজ সম্মদ। আগর গাছ কেন ক্ষয়ে যাচ্ছে সে বিষয়ে গবেষণা করতে হবে। কিভাবে আগর চাষে সফল হওয়া যায় সেই বিষয়ে চিন্তার সময় এসেছে।

কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘প্রচুর চারা উৎপাদন করতে হবে। আগর গাছ কি সমস্যার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে তা শনাক্ত করে সমাধান করতে হবে। অর্থকরী সম্ভাবনাময় এ শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে বিদেশে বাজার সৃষ্টি করতে হবে। বর্তমানে স্বল্পপরিসরে সনাতন পদ্ধতিতে আগর শিল্প চলমান। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আগরকে আধুনিক শিল্পে পরিণত করতে হবে।
তবে আগর শিল্পকে বাঁচাতে শুধু সরকারি উদ্যোগই যথেষ্ট নয়, এজন্য এগিয়ে আসতে হবে বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও। তবেই আবার ফিরবে বাংলাদেশি আগরের সুদিন।

আগরের উপযোগীতা ও উপকারিতা:

আগর উডের নির্যাশ সুগন্ধি সাবান,  স্যাম্পুসহ  অন্যান্য প্রসাধণ সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। আগর তেল ছাড়া কাঠ বা পাউডারজাত সামগ্রী থেকে ধূপের ন্যায় প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে আগরের সুবাস নেয়া হয়।



আগরের  বাণিজ্য ঃ প্রাকৃতিক বন থেকে সংগৃহীত আগর উডের মূল্য প্রতি কেজি কয়েক ডলার থেকে ১০,০০০ মার্কিন ডলার বা প্রায় ৭.৭৫ লক্ষ টাকার বেশি। মানের উপর দামের হেরফের হয়ে থাকে। আবার আবাদকৃত গাছের প্রতি কেজি আগর উডের মূল্য ৫০০০ ডলার বা প্রায় ৩.৮৭ লক্ষ টাকা। মোটামুটি মানের আগর তেলের প্রতি কেজির মূল্য ৮০০০ ডলার বা প্রায় ৬.২০ লক্ষ টাকা। তবে উচ্চ মানের আগর তেল ৫০,০০০ ডলার বা প্রায় ৩৮.৭৫ লক্ষ টাকার বেশি মূল্যে বিক্রি হয়। পৃথিবীর প্রায় ৮০ টি দেশ আগর জাত সামগ্রী আমদানী করে। প্রধান আমদানীকারক দেশ হলো-সংযুক্ত আরব আমিরাত, জাপান, সৌদি আরব ও তাইওয়ান। প্রধান রপ্তানিকারক দেশ হলো- সিংগাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দেনেশিয়াও থাইল্যান্ড। প্রতিবছর  সিংগাপুর থেকে ১.২ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৯,৩০০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের আগর জাত সামগ্রী রপ্তানি করা হয় (জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা )।

এক কেজি আগর তেলের বাজারমূল্য ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা। একটি পূর্ণবয়স্ক আগর গাছের মূল্য ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা। তেল তৈরির পর এ গাছের কাঠের টুকরোগুলো সুগন্ধি জ্বালানি হিসেবে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ব্যবহৃত হচ্ছে। মানভেদে প্রতি কেজি টুকরোর মূল্য ১০ হাজার থেকে কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত হয়।
আর ১৩ বছরের পূর্ণবয়স্ক একটি আগর গাছ থেকে প্রক্রিয়া শেষে ২৫ গ্রাম তেল পাওয়া যায়। ১ হাজার চারা রোপণ করে ১৩ বছর পর দেড় কোটি টাকা পর্যন্ত উপার্জন করা সম্ভব। অথচ এ পরিমাণ চারা তৈরি ও বনায়নের ব্যয় মাত্র ২৫ হাজার টাকা।
গাছের এমন অর্থনৈতিক উপযোগিতা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। প্রকৃতির এ অমূল্য উপহার সোনার চেয়েও যে দামি হতে পারেথ তার উদাহরণ আগর গাছ। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ গাছ থেকে বহুব্যবহার্য আগরবাতি ছাড়াও তৈরি হয় তেল। আর এ তেল ব্যবহার হয় লোশন, আতর, সুগন্ধি তেল ও সুগন্ধি তৈরিতে। আগর তেলের ঔষধি গুণের কথাও অনেকের অজানা। চর্ম, অ্যাজমা ও বাতের চিকিৎসায় অনেক আগে থেকেই এটি ব্যবহৃত হয়।
বিশ্বব্যাপী দুর্লভ এ পণ্যের মূল্য দিন দিন বাড়ছে। অনেকের কাছে অপরিচিত হলেও দেশে ক্রমে এ খাতের প্রসার হচ্ছে। কারখানা পর্যায়ে ২৫ হাজার ও মাঠ পর্যায়ে প্রায় ৬০ হাজার শ্রমিক কাজ করছেন। দেশে বর্তমানে প্রায় ১ হাজার ৭০০ আগর তেল উৎপাদনের কারখানা রয়েছে। এগুলো থেকে বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকার আগর তেল উৎপাদিত হয়। এর পুরোটাই রফতানি হচ্ছে বলে জানান বাংলাদেশ আগর অ্যান্ড আতর ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএএএমইএ) সাধারণ সম্পাদক কবীর আহমেদ চৌধুরী।
সম্প্রতি এ খাতের সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করে এবং বর্তমান সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আগরকে শিল্পের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। বিএএএমইএ সাধারণ সম্পাদকের মতে, শিল্পের মর্যাদা লাভ এ খাতের একটি বড় অর্জন। এখন এ খাতের উন্নয়নে সরকার পদক্ষেপ নিলে এটি দেশের একটি ‘প্রিমিয়াম’ পণ্য হবে। এ জন্য এখনই পরিকল্পনা গ্রহণের তাগিদ দেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি রফতানিকারকদের উৎসাহিত করতে শুল্কহার কমানোর দাবি জানান।
আগর গাছে সুগন্ধি পদার্থ সৃষ্টির কারণঃ আগর গাছের সুগন্ধি পদার্থের উৎস হলো আগর উড যা আগর গাছের জাইলেম বা কাষ্টল অংশের অভ্যন্তরে সৃষ্ট কেবল গাঢ় রংয়ের কাঠ বিশেষ। গাছের ভিতরে রেজিনযুক্ত যৌগিক পদার্থ সমৃদ্ধ আগর উড ধারণ করলে গাছটি মূল্যবান হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রাকৃতিকভাবে চাষ করা হলে আগর উড তৈরি হওয়ার সাথে গাছের বয়সের সরাসরি সম্পর্ক নেই। অর্থাৎ গাছ শারীরবৃত্ত্বীয়ভাবে পরিপক্ক হলেই রেজিন ধারণ করবে বা আগর উড সংগ্রহের জন্য গাছ কর্তন করা যাবে এমন নয়। আগর গাছে প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্ট ক্ষত এর মাধ্যমে ছত্রাকের সংক্রমণ ঘটে। প্রাকৃতিকভাবে সংক্রমণের কারণ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। ধারণা মতে Zinzera conferta  প্রজাতির stem borer  এর লার্ভা আগর গাছে ত বা গর্ত তৈরি করে, যা অনেকটা সুরঙ্গের মত। ছত্রাক এই সুরঙ্গপথে গাছের ভিতর প্রবেশ করে সংক্রমণ ঘটায়। কয়েক ধরণের ছত্রাক দ্বারা এই সংক্রমণ ঘটে থাকে। এদের মধ্যে  Aspergillus spp. Botryodiplodia spp., Diplodia spp., Fusarium  buldiferum Fusarium laterium Fusarium Oxysporum Fusarium solani  Penicillium spp Pythium spp,. উল্লেখযোগ্য। ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (defensive mechanism) স্বরূপ গাছ উচ্চ মাত্রায় উদ্বায়ী জৈব যৌগ সমৃদ্ধ এক প্রকার রেজিন উৎপন্ন করে, যা সংক্রমণ স্থলে ছত্রাকের বৃদ্ধি বা বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। আগর গাছের কাষ্টল অংশের অভ্যন্তরভাগে যেখানে রেজিন উৎপন্ন হয় সেই অংশের কাঠ হালকা বাদামী থেকে কালো বর্ণ ধারণ করে। গাছের যে যে অংশে সংক্রমণ ঘটে সেখানেই কেবল গাঢ় রংয়ের কাঠ দৃষ্ট হয়। আর উপযোগী অবস্থায় গাছ কর্তনের পর কেবলমাত্র সেই অংশগুলো সংগ্রহ করে পাতন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মূল্যবান সুগন্ধি আগর তেল সংগ্রহ করা হয় কিংবা আগর উড জাত অন্যান্য সামগ্রী তৈরি করা হয়। রেজিনযুক্ত জৈব পদার্থের মধ্যে Sesquiterpenes নামক এক বিরল উপাদানই প্রকৃতপক্ষে আগর কাঠ বা আগর তেলের সুগন্ধ প্রদান করে থাকে। কৃত্রিমভাবে এই উপাদানটি সংশ্লেষণ করা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। এ কারণে সারা পৃথিবীতে উৎকৃষ্ট মানের আগর উডের কোন বিকল্প নেই।

আগর চাষে বাংলাদেশের অবস্থানঃ আগর উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের মানদন্ডে তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। ভারতের সীমানা সংলগ্ন মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার সুজানগর ইউনিয়নে ব্যাপকভাবে আগরের আবাদ লক্ষ্য করা যায়। ছোট বড় বাগানের পাশাপাশি বসতবাটির আঙ্গিনায় পর্যন্ত আগর চাষ করা হচ্ছে। এখানকার আগর চাষের ইতিহাস প্রায় ৪০০ বছরের পূরাতন। কীভাবে এর সূচনা হয়েছে সুস্পষ্টভাবে জানা না গেলেও ধারণা করা হয় মৌলভীবাজার জেলার সীমান্তবর্তী ভারতীয় এলাকা থেকে আগর চাষের জ্ঞান ও প্রযুক্তি এদেশে এসেছে। বড়লেখা উপজেলায় আগর গাছে লোহার পেরেক ঢুকিয়ে ক্ষত সৃষ্টির মাধ্যমে সনাতন পদ্ধতিতে যে সুগন্ধি তৈরি করা হয় তা মোটেই উৎকৃষ্ট মানের নয়। ফলে বাজার মূল্যও কম। বড়লেখায় আগর উড থেকে সনাতন পদ্ধতিতে  সুগন্ধি তৈরি করার বেশ কয়েকটি কারখানা রয়েছে। যার মাধ্যমে পাতন প্রক্রিয়ায় আগর তেল বা সুগন্ধি তৈরি করা হয়

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন