তারা সরকারের কাজ করে; কিন্তু সরকারি কর্মচারী নয়। সরকার তাদের নিয়োগপত্র দেয় না। সরাসরি বেতনও দেয় না। তারা বেতন পায় সরকারি সংস্থার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান থেকে। সরকারি সংস্থা থেকে পাওয়া টাকা আর কর্মচারীটিকে দেওয়া টাকার পার্থক্যই হলো আউটসোর্সিং কম্পানির মালিকের লাভ। এ কারণেই আউটসোর্সিং কম্পানির নিরন্তর চেষ্টা কর্মচারীটিকে ঠকানোর।
আউটসোর্সিং কম্পানির চাকরির কোনো বিধিবিধান নেই। যেকোনো সময় মালিকের অসন্তুষ্টির কারণে তাদের চাকরি চলে যায়। এ চাকরিতে বেতন বৃদ্ধি, টাইম স্কেল, সিলেকশন গ্রেড, পেনশন, বোনাস—এসবের কো
আউটসোর্সিংয়ের পক্ষে সরকারের যুক্তি হচ্ছে খরচ কমানো। কর্মচারীদের প্রতিবছর বেতন বাড়াতে হয়। পাঁচ বছর পর পর দিতে হয় নতুন পে স্কেল। ৫৯ বছর বয়সে পাঠাতে হয় পিআরএলে। এর পর থেকে দিতে হয় পেনশন। সরকারি চাকরিজীবীর মৃত্যুর পরও এ পেনশন চলতে থাকে—যত দিন তাঁর স্ত্রী বেঁচে থাকেন। আউটসোর্সিংয়ে এসব ঝামেলা নেই। বছর বছর বেতন বাড়ে না। অবসরের পর পেনশন দিতে হয় না। আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে নিম্ন শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগের আরো একটি কারণ, কর্মচারীদের ট্রেড ইউনিয়ন নিয়ন্ত্রণ। কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি, কাজের সুযোগ বাড়ানো, ভালো কাজের পরিবেশ সৃষ্টি—এসব ধারণা থেকে ট্রেড ইউনিয়নের জন্ম হলেও পরে এটি অব্যবস্থাপনা, বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরকার কি শুধু খরচের কথাই চিন্তা করবে? শুধু খরচের কথা চিন্তা করলে দরিদ্র মানুষকে কেন ১০ টাকা কেজিতে চাল দেওয়া হচ্ছে? প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাসুবিধা নিশ্চিত করতে বিনা মূল্যে পাঠ্য বই দিচ্ছে। দরিদ্র মানুষকে চিকিত্সাসেবা দেওয়ার জন্য গ্রাম ও শহরে কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করেছে। সাড়ে তিন কোটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টিফিন দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। কয়েক কোটি যুবককে দক্ষ শ্রমশক্তিতে পরিণত করার জন্য বিশেষ ফান্ড তৈরি করছে।
শুধু খরচের কথা ভাবলে দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নত হবে না। প্রতিরক্ষা, প্রশাসন, আইন, বিচারব্যবস্থা সম্পর্কিত রুটিন দায়িত্বের পাশাপাশি সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তার কথা বলা হয়েছিল ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী ইশতেহারে। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী, বীমা, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, খাদ্য নিরাপত্তা, বাসস্থানের পাশাপাশি প্রতিটি ঘরে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল। একজনের বেতন দিয়ে দুজনকে চাকরি দেওয়ার মতো নামমাত্র চাকরি নয়। আউটসোর্সিং চাকরি নামের একটি দুষ্ট ক্ষত, যা ধীরে ধীরে বিস্তৃত হচ্ছে। আর এতে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রান্তিক মানুষ, সরকারি চাকরির সর্বনিম্ন বেতন স্তরে তাদের প্রবেশের পথ রুদ্ধ হচ্ছে।
আউটসোর্সিংয়ের চাকরির মাধ্যমে সমাজে স্থিতিশীলতা আসবে না। কারণ যিনি এ চাকরি করছেন তিনি জানেন এ চাকরি দিয়ে তাঁর জীবন চলবে না। জীবনে স্থিতিশীলতা আনতে তিনি আরো ভালো চাকরি খুঁজবেন। আউটসোর্সিংয়ের চাকরি দিয়ে দারিদ্র্য দূর হবে না। এই চাকরিতে যে বেতন দেওয়া হয় তা দিয়ে ভরণপোষণের দিক থেকে ছয়জনের সংসার চালানো কষ্টকর। এ প্রক্রিয়ার চাকরিতে নাগরিকদের জীবনমান উন্নয়ন সম্ভব নয়। আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে কম বেতন, চাকরির অনিশ্চয়তা ও চাকরির অন্যান্য প্রতিকূল শর্তের কারণে এ পদ্ধতিতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীরা সার্বক্ষণিকভাবে অভাব-অনটনের মধ্যে থাকেন। তাঁরা যেকোনো সময় চাকরি চলে যাওয়ার আতঙ্কে থাকেন। নিম্ন বেতন ও চাকরির অনিশ্চয়তার কারণে তাঁরা কাজে মনোযোগী হন না।
আউটসোর্সিং নীতিমালা ২০০৮ সালে প্রথম জারি করা হয় অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে। কিন্তু রুলস অব বিজনেস এবং অ্যালোকেশন অব বিজনেস অনুযায়ী এ নীতিমালা প্রণয়নের কাজ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের। কারণ রুলস অব বিজনেসে বলা হয়েছে—কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের অর্গানোগ্রাম, জনবল নিয়োগ, নিয়োগবিধি, চাকরিবিধি-সংক্রান্ত কাজ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালরেয়র এখতিয়ারভুক্ত। ২০০৮ সালে নীতিমালা জারির আট বছর পর অর্থ মন্ত্রণালয়ের মনে হয়েছে, এ কাজটি তাদের নয়। তাই এবার আউটসোর্সিংয়ের খসড়া নীতিমালা করা হয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে।
গত ৩ জানুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে সেবাগ্রহণের ইতিবাচক ও নেতিবাচক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে বলা হয়, বিভিন্ন উন্নত দেশে এ ধরনের কার্যক্রমে তালিকাভুক্ত কম্পানির মাধ্যমে জনবল সরবরাহ করা হয়। যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার জন্য এর দায়-দায়িত্ব কম্পানিকেই বহন করতে হয়। আমাদের দেশে সুষ্ঠু আউটসোর্সিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এ ধরনের কম্পানিকে লাইসেন্সিংয়ের আওতায় আনতে হবে। জনবলের আউটসোর্সিং কার্যক্রমটি শৃঙ্খলায় আনার জন্য স্বচ্ছ নীতিমালা এবং লাইসেন্সিংয়ের আওতায় এনে তালিকাভুক্ত কম্পানিগুলোর ডাটা বেইস তৈরি করতে হবে। যে কেউ যাতে নামমাত্র প্রতিষ্ঠান খুলে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে জনবল সরবরাহ করতে না পারে সে জন্য জনবল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর রেগুলেশন ও রেজিস্ট্রেশন থাকা প্রয়োজন।
আউটসোর্সিং কিভাবে কাজ করে
সরকারি প্রতিষ্ঠান চুক্তি করে কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। সাধারণত কোনো সরকারি অফিসে নির্দিষ্ট পদে দৈনিক, মাসিক বা বার্ষিক ভিত্তিতে প্রতিযোগিতামূলক দামে স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা গ্রহণ করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় জনবল সরবরাহের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। বিজ্ঞপ্তিতে সাড়া দিয়ে জনবল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তার প্রত্যাশিত বেতন উল্লেখ করে টেন্ডারে অংশ নেয়। সরকারি অফিসটি সর্বনিম্ন বেতন প্রস্তাবকারীকে জনবল সরবরাহের জন্য কার্যাদেশ দেয়। সরকারি সংস্থা জনবল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে চুক্তিবদ্ধ টাকা পরিশোধ করে। এ ব্যবস্থায় তাঁরা সরকারের স্থায়ী কর্মচারী নন। এমনকি তাঁরা অস্থায়ী কর্মচারীও নন। কর্মচারীটি ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী। কাজ করেন অন্য কোনো সরকারি, আধাসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে।
নতুন নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত : পদ শূন্য হলেই আউটসোর্সিং
মৃত্যু, অবসর, চাকরিচ্যুতি বা অন্য কোনো কারণে পদ শূন্য হলেই এসব পদে আউটসোর্সিং থেকে লোক নিয়োগ করা হবে। অর্থাত্ একবার পদটি শূন্য হলে তা আউটসোর্সিংয়ের চক্করে চলে যাবে। তা পূরণ হবে বেসরকারি জনবল দিয়ে—আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে। ১৬ থেকে ২০তম গ্রেডের স্থায়ী ও অস্থায়ী সব পদেই এভাবে জনবল নিয়োগ দেওয়ার বিধান করে ‘আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় সেবাগ্রহণ নীতিমালা, ২০১৭-এর খসড়া প্রণয়ন করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
১৬ থেকে ২০ গ্রেডের সরকারি কর্মচারীরা হচ্ছে সদ্য বিলুপ্ত চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। সাড়ে ১২ লাখ সরকারি কর্মচারীর মধ্যে তাদের সংখ্যা তিন লাখ ২৬ হাজার ৬২০টি। এর মধ্যে বর্তমানেই ৭০ হাজার ৪৮টি পদ শূন্য রয়েছে। আউটসোর্সিং নীতিমালা চূড়ান্ত হলে এসব শূন্য পদে দ্রুত নিয়োগ দেওয়া হবে।
খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, যেসব পদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, গোপনীয়তা ও সরকারি স্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে সে সব পদ জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মত্তিসাপেক্ষে আউটসোর্সিংয়ের আওতা বহির্ভূত রাখা হবে।
নীতিমালায় কর্মচারীর কর্মঘণ্টার কোনো বিষয় নির্ধারণ করা হয়নি। কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত কর্মঘণ্টাই কর্মচারীর কর্মঘণ্টা নির্ধারণ হবে। তবে কর্তৃপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী অতিরিক্ত সময় কাজ করলে চুক্তি অনুযায়ী অতিরিক্ত পারিশ্রমিক দেওয়া হবে।
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স সর্বোচ্চ ৩০ বছর হলেও আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় সরবরাহকৃত জনবলের বয়স সর্বনিম্ন ১৮ বছর এবং সর্বোচ্চ ৫৯ বছর। সরকারি পদে গাড়িচালক হতে হলে অষ্টম শ্রেণি পাস হলেই চলে। কিন্তু আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় গাড়িচালককে এসএসসি পাস হতে হবে। নিরাপত্তা প্রহরী ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে শিক্ষাগতযোগ্যতা হবে ন্যূনতম অষ্টম শ্রেণি পাস। তবে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর ৮০ শতাংশই হরিজন সম্প্রদায়ের হতে হবে। হরিজন সম্প্রদায়ের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করা হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন