শনিবার, ২১ মে, ২০১৬

সূরা দুখানের ৩-৪নং আয়াত শরীফ-এ বর্ণিত ‘লাইলাতুম্ মুবারাকাহ্’ দ্বারা ‘লাইলাতুল ক্বদরকে’ বুঝানো হয়েছে? না ‘শবে বরাতকে’ বুঝানো হয়েছে?

সূরা দুখানের ৩-৪নং আয়াত শরীফ-এ বর্ণিত ‘লাইলাতুম্ মুবারাকাহ্’ দ্বারা ‘লাইলাতুল ক্বদরকে’ বুঝানো হয়েছে? না ‘শবে বরাতকে’ বুঝানো হয়েছে?
সূরা দুখানের ৩নং আয়াত শরীফ-এ উল্লিখিত ‘লাইলাতুম্ মুবারাকাহ’ দ্বারা ‘লাইলাতুল ক্বদরকে’ বুঝানো হয়নি বরং ‘লাইলাতুল বরাত’ বা ‘শবে বরাতকেই’ বুঝানো হয়েছে।
কেননা, ‘লাইলাতুল ক্বদর’-এর মর্তবা ও ফযীলত সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক তিনি ‘সূরা ক্বদর’ নামে আলাদা একটি সূরাই নাযিল করেছেন। যার শানে নুযূল এবং ব্যাখ্যাও আলাদাভাবে বর্ণিত রয়েছে। উক্ত ‘সূরা ক্বদরে’ আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ করেন-
انا انزلنه فى ليلة القدرড় وما ادرك ما ليلة القدرড় ليلة القدر خير من الف شهرড় تنزل الـملئكة والروح فيها باذن ربهم من كل امر سلمড় هى حتى مطلع الفجرড়
অর্থ: “নিশ্চয়ই আমি কুরআন শরীফ নাযিল করেছি ক্বদরের রাত্রিতে। আপনি কি জানেন, ক্বদরের রাত্রি কি? অর্থাৎ আপনি তো জানেন ক্বদরের রাত্রি সম্পর্কে। ক্বদরের রাত্রি হাজার মাস থেকেও উত্তম। উনাদের রব-উনার অনুমতিক্রমে রূহ (হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম) ও ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা এ রাতে পৃথিবীতে অবতরণ করেন প্রত্যেক কাজে বা হুকুমে। শান্তি নাযিল হয়। উহা (ক্বদর রাত্রি) ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত (বলবৎ থাকে)।”
শানে নুযূল: হযরত ইবনে আবী হাতিম রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার থেকে বর্ণিত রয়েছে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি একবার বনী ইসরাইলের জনৈক মুজাহিদ সম্পর্কে আলোচনা করলেন। যিনি এক হাজার মাস পর্যন্ত অবিরাম জিহাদে মশগুল থাকেন এবং কখনো অস্ত্র সংবরণ করেননি। মুসলমানগণ একথা শুনে বিস্মিত হলে এ ‘সূরা ক্বদর’ অবতীর্ণ হয়। এতে উম্মতে হাবীবীর জন্য শুধু এক রাত্রির ইবাদতই সেই মুজাহিদের এক হাজার মাসের ইবাদত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করা হয়েছে। সুবহানাল্লাহ! (তাফসীরে মাযহারী)
ক্বদরের অর্থ ও ব্যাখ্যা: ‘ক্বদরের’ অর্থ হচ্ছে মাহাত্ম্য ও সম্মান। এ রাত্রির মাহাত্ম্য ও সম্মানের কারণে একে ‘লাইলাতুল ক্বদর’ তথা ‘মহিমান্বিত রাত’ বলা হয়। এ রাত্রিকে ‘ক্বদর’ বলার কারণ সম্পর্কে বর্ণিত রয়েছে, আমল না করার কারণে এর পূর্বে যার কোনো সম্মান অর্জিত হয়না। যখন এ রাত্রিতে তওবা-ইস্তিগফার ও ইবাদত-বন্দিগী করা হয় তখনই ফযীলত ও সম্মান হাছিল হয়।
কাজেই লাইলাতুল ক্বদর বা শবে ক্বদর ও লাইলাতুল বরাত বা শবে বরাত একই রাত্রির নাম নয়। বরং উভয় রাত্রি দুটিই আলাদা এবং যার বর্ণনাও কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এ আলাদাভাবেই বর্ণিত হয়েছে। ‘লাইলাতুল ক্বদরের’ কথা বর্ণিত রয়েছে সূরা ক্বদরে। আর ‘লাইলাতুল বরাতের’ কথা বর্ণনা করা হয়েছে সূরা দুখানে ‘লাইলাতুম্ মুবারাকাহ’ বা ‘বরকতময় রজনী’ হিসেবে।
সূরা দুখানে বর্ণিত ‘লাইলাতুম্ মুবারাকাহ’ দ্বারা যে ‘লাইলাতুল বরাত বা শবে বরাতকে’ বুঝানো হয়েছে তা প্রায় সকল বিশ্বখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য তাফসীর গ্রন্থেই বর্ণিত রয়েছে।
যেমন, সূরা দুখানে উল্লিখিত ليلة (লাইলাতুম্ মুবারাকাহ)-এর ব্যাখ্যায় বিশ্বখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ “তাফসীরে মাযহারী”-এর ৮ম খ-ের ৩৬৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
قال عكرمة هى ليلة النصف من شعبان يبرم فيه امر السنة
অর্থাৎ, বিশিষ্ট ছাহাবী হযরত ইকরামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, ‘লাইলাতুম্ মুবারাকাহ’ হচ্ছে ‘শা’বানের মধ্য রাত্রি’ অর্থাৎ ‘বরাতের রাত্রি’। এ রাতে সারা বছরের কাজ-কর্মের ফায়ছালা করা হয়।
উক্ত আয়াত শরীফ-এর ব্যাখ্যায় রঈসুল মুফাস্সিরীন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন-
قد اخبر الله سجانه عن هذه الليلة المباركة التى هى ليلة النصف من شعبان انه تعالى يفرق فيها كل امر من اموره المحكمة.
অর্থ: “মহান আল্লাহ পাক তিনি ‘লাইলাতুম্ মুবারাকাহ্ অর্থাৎ বরকতময় রাত্রি বলতে শা’বান মাসের মধ্য রাত অর্থাৎ শবে বরাতকে বুঝিয়েছেন। আল্লাহ পাক তিনি এ রাতে সকল প্রজ্ঞা সম্পন্ন বিষয়ের ফায়ছালা করে থাকেন।” (ছফওয়াতুত্ তাফাসীর)
বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ “তাফসীরে খাযিন”-এর ৪র্থ খ-ের ১১২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
(انا انزلناه فى ليلة مباركة) هى ليلة النصف من شعبان.
অর্থ: “নিশ্চয়ই আমি এটা এক বরকতময় রাত্রিতে নাযিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ‘লাইলাতুম্ মুবারাকাহ্’ হলো অর্ধ শা’বানের রাত তথা শবে বরাত।”
সুপ্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ “তাফসীরে বাগবী”-এর ৬ষ্ঠ খ-ের ১৪৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
(انا انزلناه فى ليلة مباركة) وقال اخرون ليلة النصف من شعبان
অর্থাৎ- “নিশ্চয়ই আমি এটা এক বরকতময় রাত্রিতে নাযিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অসংখ্য রাবীগণ বলেন, ‘লাইলাতুম্ মুবারাকাহ’ তথা বরকতময় রাত্রি হচ্ছে অর্ধ শা’বানের রাত অর্থাৎ শবে বরাত।”
“তাফসীরে নাযমুদ্ দুরার”-এর ৭ম খ-ের ৬২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
ليلة مباركة
দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে-
ليلة النصف من شعبان
অর্থাৎ “অর্ধ শাবানের রাত তথা বরাতের রাত।” তাফসীর জগতের সুবিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ “তাফসীরে কুরতুবী”-এর ৮ম খ-ের ১২৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
قال عكرمة الليلة المباركة ههنا ليلة النصف من شعبان
অর্থ: “বিশিষ্ট ছাহাবী হযরত ইকরামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, লাইলাতুম্ মুবারাকাহ দ্বারা এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্ধ শাবানের রাত অর্থাৎ শবে বরাত।” বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ “তাফসীরে লুবাব”-এর ১৭তম খ-ের ৩১০ ও ৩১১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
(فيها) اى فى الليلة المباركة (يفرق) يفصل (كل امر حكيم) وقال عكرمة هى ليلة النصف من شعبان يقوم فيها امر السنة.
অর্থ: “ওই বরকতময় রাত্রিতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ যাবতীয় বিষয়ের ফায়ছালা করা হয়। বিশিষ্ট ছাহাবী হযরত ইকরামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, ‘লাইলাতুম্ মুবারাকাহ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্ধ শাবানের রাত তথা শবে বরাত। এ রাতে আগামী এক বছরের যাবতীয় বিষয়ের তালিকা প্রস্তুত করা হয়।”
উপরোক্ত বিশ্বখ্যাত, সুপ্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য তাফসীরগ্রন্থসমূহ ছাড়াও তাফসীরে আবী সউদ, বাইযাবী, দুররে মানছূর, তাফসীরে জালালাইন, তাফসীরে কামালাইন, তাফসীরে তাবারী, তাফসীরে গরায়িব, তাফসীরে রুহুল বয়ান, তাফসীরে রুহুল মায়ানী, তাফসীরে যাদুল মাছীর, তাফসীরে আল মুহাররারুল ওয়াজিয, তাফসীরে মাওয়াহিব, হাশিয়ায়ে শিহাব, তাফসীরে ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, তাফসীরে দুররে মাছূন, তাফসীরে কাশ্শাফ, তাফসীরে দিয়াউল কুরআন, তাফসীরে আহকামুল কুরআন, তাফসীরে কাসীমী, তাফসীরে মিযান, তাফসীরে মাওয়ারদী, নূরুল ইরফান, তাফসীরে মুগনী, তাফসীরে বাহরে মাওয়াজ, তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন ইত্যাদি তাফসীরগ্রন্থে ‘লাইলাতুম্ মুবারাকাহ’ দ্বারা ‘লাইলাতুল বরাত’ বা ‘শবে বরাতকে’ বুঝানো হয়েছে।
সূতরাং প্রমান হলো শবে ক্বদর ও শবে বরাত এক বিষয় নয়।
(...................চলবে..................)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন