মঙ্গলবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৬

সাপের বিষেই শতকোটি টাকা !

রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে বেশ কয়েকটি চক্র গোখরো সাপের বিষ (কোবরা ভেনম) চোরাচালান ও কেনাবেচার সাথে জড়িত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে কোবরা ভেনম উদ্ধার করেছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, এই সাপের বিষ বাংলাদেশের নয়, এটি ফ্রান্সের রেড ড্রাগন কোম্পানির তৈরি। এই বিষের বোতলের মুখ হাতে খোলা যায় না। বিশেষ এক ধরনের যন্ত্র বা গানের সাহায্যে খুলতে হয়। বোতলের মুখে যে ছিপি তাতে বিশেষ যন্ত্র ঠেকিয়ে ‘ফায়ার’ করলে বোতলের মুখ খুলে যায়। এই গানের সাহায্য ছাড়া কোন ভাবেই বোতলের মুখ খোলা যায় না।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এই ভেনম চোরাচালানের রুট হিসেবে বাংলাদেশের মাটিকে ব্যবহার করা হয়। ইউরোপের দেশগুলোতে এই বিষ নেশা জাতীয় দ্রব্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং বিষ থেকে ওষুধ তৈরি করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানী ঢাকার অভিজাত পাড়া হিসেবে পরিচিত গুলশান এলাকায় এই কোবরা ভেনম চোরাচালান ও কেনাবেচার কয়েকটি চক্র রয়েছে।
সম্প্রতি হাতিরঝিলে মধুবাগ ব্রিজের কাছে বসে কথা বলছিলেন এরকমই একটি চক্রের সদস্যরা। পাশ থেকে তাদের কথা শুনে এ প্রতিবেদক তাদের কাছে এগিয়ে গিয়ে নিজের পরিচয় দেন এবং তাদেরকে অভয় দিয়ে কথা বলা শুরু করেন।
তারা এ প্রতিবেদকের মোবাইল ফোন নিয়ে নেন। রেকর্ডিং অন করা আছে কি-না পরীক্ষা করে দেখেন। কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা এ প্রতিবেদকের মোবাইল ফোন নিজেদের কাছে রাখেন। তাদের মোবাইল ফোন নম্বর চাইলেও কেউ দেন নি। এরপর কয়েকবার হাতিরঝিলে গিয়ে আর তাদের পাওয়া যায় নি।
ওই দিন এই চক্রের একজন জানান, তারা কোবরা ভেনম বিক্রির জন্য ঘুরছেন। কিন্তু ছয়টি বোতলের পূর্ণ সেট তাদের কাছে না থাকায় বিক্রি করতে পারছেন না। ক্রেতারা তাদের প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না। কারণ, ছয়টি বোতলের একটি সেট থাকার কথা থাকলেও তাদের কাছে পুরো সেট নেই, আছে চারটি বোতল। এগুলোর মুখ খোলার জন্য বিশেষ যন্ত্র বা গানও তাদের কাছে নেই।
আরেকজন জানান, তারা দিনে অন্য কাজ করেন। কেউ পোশাক কর্মী, কেউ গাড়ির চালক, কেউ জমি কেনাবেচার দালাল হিসেবে কাজ করেন। সন্ধ্যার পর সবাই একসাথে বসেন। তারা জানান, তাদের কাছে যে বিষ রয়েছে তা বিক্রি করতে না পারায় কারো মনেই স্বস্তি নেই। বিষ বিক্রি হলে যে টাকা পাবেন তা দিয়ে জীবনকে নতুনভাবে সাজানোর স্বপ্ন দেখছেন কেউ কেউ। অনেক দিন ধরে ঘুরেও তারা এ বিষ বিক্রি করতে পারছেন না। ফলে দিন যত যাচ্ছে, তাদের হতাশা ততো বাড়ছে। এর ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার ভয় তো রয়েছেই।
তারা জানান, তাদের দলে ৪০ থেকে ৫০ জন ছিলো। একজন নারীও রয়েছেন। এটা বিক্রির জন্য কেউ কেউ দুই-একদিন ঘুরেই হতাশ হয়ে পড়েন এবং শেষমেষ এ কাজে আর সময় দেন নি। ফলে বিক্রেতার তালিকা থেকে তার নাম বাদ পড়ে যায়। দিনদিন এই চক্রের সদস্যের সংখ্যাও কমছে।
এই চক্রের একজন জানান, প্রতিসেটের বোতলগুলোর গায়ে সুন্দর নকশা করা। বোতলগুলো দেখলে ঘরে সাজিয়ে রাখতে ইচ্ছে করবে। বোতল গোলাকার। প্রতিটি বোতলে থাকে দুই পাউন্ড করে সাপের বিষ। দুটি বোতলে তরল বিষ থাকে চার পাউন্ড, দুটি বোতলে গুড়া (পাওডার) বিষ থাকে চার পাউন্ড ও দুটি বোতলে দানাদার বিষ থাকে চার পাউন্ড। ছয়টি বোতলে থাকে মোট ১২ পাউন্ড বিষ। তরল বিষের রঙ নীল এবং গুড়া ও দানাদার বিষের রঙ সাদা। ছয়টি বোতলের একসেট বিষের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় একশ কোটি টাকা।
যাদের সাথে কথা হয়েছে, তারা কেউই জানেন না এই বিষের বোতল কার কাছে আছে। শুধু জানেন বিক্রির জন্য দরদাম চুড়ান্ত হলে বিষ পাওয়া যাবে।
ফ্রান্সের বিষ কীভাবে বাংলাদেশে এলো- এ প্রশ্ন তাদেরকে করা হলে কেউই সুষ্পষ্ট কিছু বলতে পারেননি। তারা জানান, তারা শুধু বিষের বোতলের ছবি নিয়ে বিক্রির জন্য ক্রেতা খোঁজেন। ক্রেতা পাওয়া গেলে ক্রেতার প্রতিনিধি এবং কোবরা ভেনম বিক্রেতার প্রতিনিধির মধ্যে প্রথমে ছবি দেখাদেখি হয়। এরপর হয় ভিডিও দেখাদেখি। পত্রিকার উপর বিষের বোতল রেখে ছবি তুলতে হয় বা ভিডিও করতে হয় যাতে ভিডিও করার বা ছবি তোলার তারিখ স্পষ্ট দেখা যায়। এ ছাড়া ক্রেতার প্রতিনিধি টাকার নোটের ওপর তারিখ লিখে দেন। সেই নোটটি বোতলের উপর রেখে ভিডিও করে বা ছবি তুলে দেয়া হয়। সেই ছবি বা ভিডিও দেখে ক্রেতার প্রতিনিধি নিশ্চিত হন যে, ওই ব্যক্তির কাছে কোবরা ভেনম আছে।
এরপর বিক্রেতার কাছে চাওয়া হয় ক্যাটালগ। দাম নির্ভর করে ক্যাটালগের উপর। ক্যাটালগে এই বিষ সম্পর্কে বিস্তারিত দেয়া থাকে। ক্যাটালগ না থাকলে বিষ বিক্রি হয় না। কোন ক্রেতা বা বায়ারকেই প্রথমে মূল ক্যাটালগ দেয়া হয় না। ক্যাটালগের রঙিন ফটোকপি দেয়া হয়। এটা দেখে পছন্দ হলে দাম নির্ধারণ হয়।
এরপরের ধাপে হয় স্যাম্পল পরীক্ষা। প্রতিসেট বোতলের সঙ্গে থাকে স্যাম্পল। বায়ার ল্যাবরেটরিতে স্যাম্পল পরীক্ষা করেন। অবশ্য চক্রের সদস্যরা জানান, আমাদের দেশে এই স্যাম্পল পরীক্ষা করার মত কোন ল্যাবরেটরি নেই। স্যাম্পল থাকে শ্যাম্পূর প্যাকেটের মত ছোট প্যাকেটে। স্যাম্পলের কোড নাম্বার এবং মূল বোতলের কোড নাম্বার এক থাকে। মূল বোতলের সেট বুঝে নেওয়ার সময় এই কোড নম্বর মিলিয়ে নেয়া হয়।
চক্রের সদস্যরা জানান, তাদের কাছে থাকা চার বোতলের দাম কোন বায়ারের প্রতিনিধি তিন কোটি, কেউ পাঁচ কোটি বলেছেন। বিক্রি করে দেওয়ার জন্য বায়ারের প্রতিনিধিকে কমিশন দিতে হবে অর্ধেক টাকা। তিনকোটি টাকার মধ্যে অর্ধেক দিলে তাদের জনপ্রতি থাকবে দুই লাখ থেকে তিন লাখ টাকা। অনেক সময় বায়ারের প্রতিনিধি বিভিন্ন তালবাহানা করেন। এ কারণেও তারা বায়ারের প্রতিনিধির প্রতি বিশ্বাস আনতে পারেন না। কারণ, টাকা হাতে পাবেন কি পাবেন না তা নিয়েও থাকে নিশ্চয়তা।
এই বিষ দিয়ে কি হয়- এ প্রশ্ন করা হলে তারা জানান, তারা শুনেছেন দূরারোগ্য ব্যাধির ওষুধ নাকি তৈরি করা হয়।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক জানান, চীন ও তাইওয়ানে আগে নেশার দ্রব্য হিসেবে সাপের বিষ ব্যবহার হতো। সাধারন মাদকদব্যে যাদের কাজ হতো না, তারা সাপের বিষের (তরল করতে করতে মাত্রা কমিয়ে ফেলা) মাত্রা একেবারে কমিয়ে ব্যবহার করতো। চীনে যখন মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বে বিপ্লব হয় তখন মাদকদ্রব্যের সব কারখানা ও দোকান পুড়িয়ে দেয়া হয়।
অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, ‘ওই সব এলাকায় কালো বাজারে বিষের এখনো চাহিদা আছে। এ ব্যাপারে আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে খবরাখবর পাই।’
তিনি আরো বলেন, ‘ইউরোপে কোন কোন ওষুধ কোম্পানি সাপের বিষ কিনে থাকে। সাপের বিষ খুবই দামি এবং বহনে সুবিধা। বাংলাদেশে এর কোন ব্যবহার নেই। অতো হাই টোকনোলজির ওষুধ কোম্পানি বাংলাদেশে নেই। রেড ড্রাগন কোম্পানির যে কোবরা ভেনম আমাদের দেশে ধরা পড়ে তা এখানে ব্যবহারের জন্য আসে না। বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে ইউরোপের দেশগুলোতে চোরাচালান হয়ে যায়।’ বিভিন্ন তথ্যে জানা যায়, সর্বশেষ গত ২ আগস্ট চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার নীলমনিগঞ্জের পিটিআই মোড় থেকে প্রায় ১২ কোটি টাকা মূল্যের সাপের বিষসহ মোহাম্মদ সোহেল নামের (৪০) এক ব্যক্তিকে আটক করে বিজিবি। পরে তাকে চুয়াডাঙ্গা থানায় হস্তান্তর করা হয়।
এ ব্যাপারে চুয়াডাঙ্গা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) তোজাম্মেল হক শনিবার সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের জানান, গ্রেপ্তার মোহাম্মদ সোহেলের কাছ থেকে তেমন কিছ্ ুজানা সম্ভব হয় নি। সে কারাগারে আছে। তাকে রিমান্ডে আনার ব্যাপারে আদালতে আবেদন করা হয়েছে। বিষ পাঠানো হয়েছিলো নমুনা পরীক্ষার জন্য। কিন্তু বিষের বোতলের মুখ খোলা সম্ভব হয় নি। পরে তা র‌্যাবের ফরেনসিক বিভাগে পাঠানোর জন্য আদেশ দিয়েছেন আদালত। সেখানে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।
চলতি বছরের ৭ মার্চ রাজধানীর লালবাগ থানার ইরাকি কবরস্থান মাঠের পশ্চিম পাশে একটি ৪র্থ তলা ভবনের নিচ তলার ফ্ল্যাটে অভিযান চালায় র‌্যাব ১০। এসময় তারা ১২ পাউন্ড সাপের বিষ উদ্ধার করে যার বাজার মূল্য প্রায় ৪৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া পাচারকারী চক্রের তিন সদস্যকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করা হয়। এদিন সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে র‌্যাব জানায়, চক্রটি সাপের বিষ বিদেশে পাচার করে আসছিল।
এ ব্যাপারে রোববার বিকেলে র‌্যাব ১০ এর স্কোয়াড কমান্ড (সিপিসি-১) শেখ জিল্লুর রহমান মুঠোফোনে বলেন, ‘আমরা যেটা উদ্ধার করেছিলোম তার প্যাকেট ইনট্যাক্ট ছিলো। গায়ে লেখা ছিলো, মেড ইন ফ্রান্স। এটা কোবরা (গোখরো) সাপের বিষ। নির্দিষ্ট গান ছাড়া জারের মুখ খোলা যায় না। গানের সাহায্যে ফায়ার করলে মুখটা খুলবে।’
এই বিষ ফ্রান্স থেকে আসছে না কি আমাদের দেশে তৈরি হচ্ছে- এ প্রশ্নে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘না না, আমাদের দেশে এটা তৈরি হচ্ছে না। কারণ, এই যে জারটা, এই জারটাই তো আমাদের দেশে তৈরি করতে পারবে না।’ এই বিষ দিয়ে কি হয় তা জানা যায় নি বলে জানান র‌্যাবের এই কর্মকর্তা।
এছাড়া ২০১৫ সালের ২৪ জুলাই সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার রাউতগ্রাম থেকে ১২ পাউন্ড গোখরোর বিষ উদ্ধার করে র‌্যাব-৯ এর একটি দল। এ সময় সাতজনকে আটক করা হয়। একটি ক্যাটালগও পাওয়া গিয়েছিলো। উদ্ধার করা বিষের মূল্য ছিলো ৪৬ কোটি টাকা।
২০১৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর জয়পুরহাটে একটি আবাসিক হোটেল থেকে ১২ পাউন্ড কোবরার বিষ উদ্ধার করেন র‌্যাব-৫ জয়পুরহাট ক্যাম্পের সদস্যরা। ওই চক্রের ৫ সদস্যকে আটক করা হয়। উদ্ধার করা বিষের মূল্য ৬৮ কোটি টাকা বলে সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিলো র‌্যাব।
২০১৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর উত্তরা থানা এলাকা থেকে ছয় বোতল সাপের বিষ উদ্ধার করে পুলিশ। এই বিষের আনুমানিক মূল্য ১২ কোটি টাকা।
২০১০ সালে মতিঝিল থেকে র‌্যাব সদস্যরা দুই আউন্স সাপের বিষ উদ্ধার করে। ২০০৯ সালের আগস্টে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে একটি আবাসিক হোটেল থেকে ১২ আউন্স সাপের বিষ উদ্ধার করে র‌্যাব। ২০০৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পাবনার ফরিদপুর উপজেলা থেকে ১২ পাউন্ড সাপের বিষ উদ্ধার করে র‌্যাব-১২ এর সদস্যরা। দেশে এরকম বিভিন্ন সময়ে গোখরো সাপের বিষ উদ্ধারের নজির রয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন