শুক্রবার, ১ জানুয়ারী, ২০১৬

বজরঙ্গি ভাইজান :: অন্তরালের রাজনীতি ২০০২ সালে গুজরাটের আহমেদাবাদে যে দুই সহস্রাধি

বজরঙ্গি ভাইজান :: অন্তরালের রাজনীতি
২০০২ সালে গুজরাটের আহমেদাবাদে যে দুই সহস্রাধিক মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছিল তার পেছনেও ছিল আরএসএস–এর ‘হিন্দু ভারত’ গঠনের ঘৃণ্য চক্রান্ত। ঐ মুসলিম–নিধনযজ্ঞের অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন বাবুভাই প্যাটেল, যিনি ‘বাবু বজরঙ্গি’ হিসেবে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে গুজরাটে ৯৭ জন মুসলমানকে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছিল। এই বাবু বজরঙ্গি হলেন আরএসএস–এর ভাবাদর্শে গঠিত জঙ্গি হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বজরঙ্গ দলের নেতা।
উল্লেখ্য, এই বজরঙ্গ দলও সংঘ পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। বজরঙ্গ দলের একটি ঘোষিত লক্ষ্য হলো অযোধ্যায় রামমন্দির, মথুরায় কৃষ্ণমন্দির এবং বানারসে বিশ্বনাথ মন্দির নির্মাণ করা। এরা প্রকাশ্যেই ভারতের মুসলিম, খ্রিস্টান সহ বিভিন্ন সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বী এবং বামপন্থী সহ অন্যান্য প্রগতিশীল শক্তিকে ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক পরিচয়, যেটা হলো তাদের ভাষ্যমতে হিন্দুত্ববাদ ছাড়া আর কিছুই নয়, তার জন্য বিপজ্জনক হিসেবে আখ্যায়িত করে আসছে। অনিবার্যভাবেই বজরঙ্গ দলের সকল প্রকার তৎপরতার লক্ষ্যবস্তু যে ভারতবর্ষের অহিন্দু জনগোষ্ঠী এবং হিন্দুত্ববাদ–বিরোধী প্রগতিশীল শক্তিই হবে তাতে আর সন্দেহ কী?
এই বজরঙ্গ দলের নেতা হিসেবেই বাবু বজরঙ্গি ২০০২ সালে গুজরাটে উপর্যুক্ত নিধনযজ্ঞ চালিয়েছিলেন। ২০০৭ সালে তার একটি সাক্ষাৎকার গোপন ভিডিও ক্যামেরায় ধারণ করা হয়। ঐ সাক্ষাৎকারে তিনি গুজরাট হত্যাকাণ্ডে তার অংশগ্রহণের কথা সদম্ভে ঘোষণা করেছিলেন, উদ্ধতভাবে বলেছিলেন মুসলিমদের কোনো মোকাম তিনি অক্ষত রাখেননি, যাকেই হাতের কাছে পেয়েছেন কুপিয়ে অথবা পুড়িয়ে হত্যা করেছেন। তার ভাষায়, ঐ ‘বেজন্মা’গুলো যেহেতু মৃত্যুর পর দগ্ধ হতে চায় না, এ জন্য জীবন্তদগ্ধ করে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা তিনি করেছেন। তার এই কাজের জন্য তাকে যদি ফাঁসিতে ঝোলানো হয় তাতেও তার আফসোস নেই, বরং ফাঁসির আগে হাতে দুইদিন সময় পেলেও ২৫,০০০ থেকে ৫০,০০০ মুসলমানকে তিনি হত্যা করবেন।
উল্লেখ্য, ঐ ঘটনার প্রেক্ষিতে থানায় তার নামে অভিযোগ দায়ের করা এবং সেই অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হলেও তিনি জামিনে মুক্ত হয়ে আসেন। গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী (ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) নরেন্দ্র মোদী তাকে ছাড়িয়ে আনার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেছিলেন।
পরবর্তীতে গোপন ভিডিওতে ধারণকৃত বাবু বজরঙ্গির স্বীকারোক্তির প্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে যে মামলা হয় তাতে ২০১২ সালে তাকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হলে তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত হন। এই হলো বজরঙ্গ দলের প্রধান নেতার অবস্থা। তবে এ কথা অবশ্যই মনে রাখা দরকার যে, বাবু বজরঙ্গির উপর্যুক্ত অবস্থানকে একান্ত ব্যক্তিগত মনে করলে বড় ভুল করা হবে। এটা তাদের সমগ্র সংগঠন, সেই হিসেবে আরএসএস–এরও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং অবস্থান। এই আরএসএস–এর মুখপাত্র হিসেবেই নরেন্দ্র মোদী ভারতের শীর্ষপদে আসীন হয়ে ইতিহাস, বিজ্ঞান থেকে শুরু করে সমস্ত কিছুর মধ্যে হিন্দু ধর্মের ‘মাহাত্ম্য’ আবিষ্কার করে সেই মাহাত্ম্য প্রচারের নামে পক্ষান্তরে উগ্র সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শ চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন সমগ্র জনগণের ওপর।
ওপরে যে বজরঙ্গ দলের কথা সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো সেই দলের পরম পূজনীয় দেবতা বজরঙ্গ তথা হনুমানের একান্ত অনুগত সেবক হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে ‘বজরঙ্গি ভাইজান’ সিনেমার প্রধান চরিত্র পবন কুমারকে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, রামায়ণের অন্যতম চরিত্র হিসেবে হনুমানকে দেবতা হিসেবে মান্য করার সাথে উগ্র সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের কোনো আত্যন্তিক সম্পর্ক নেই। কিন্তু ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত বিচারে এটা বোঝা কঠিন নয় যে, একজন হনুমান–ভক্ত হিসেবে পবন কুমারকে সত্যনিষ্ঠ, ন্যায়পরায়ণ, পরোপকারী ও মহানুভব যুবক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে একাধিকবার– এর আসল লক্ষ্য হলো বজরঙ্গ দল তথা আরএসএস–এর মতাদর্শকেই মহিমান্বিতরূপ ঊর্ধ্বে তুলে ধরা।
‘বজরঙ্গি ভাইজান’ চলচ্চিত্রের কাহিনী যতোই মর্মস্পর্শী হোক না কেন, যতোই অভিনন্দিত হোক সালমান খান, হর্ষালি মালহোত্রা, কিংবা নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীর অনবদ্য অভিনয়, এর অন্তরালের রাজনীতিটুকু উন্মোচন না করে কেবল আবেগে ভেসে গেলে আমাদের চলছে না। চলচ্চিত্রের রস সবটুকু আস্বাদন করেও আমাদেরকে বলতেই হচ্ছে, এই কাহিনী আসলে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত রাষ্ট্রের আধিপত্যকামী শক্তি হয়ে ওঠার আখ্যান, এই চলচ্চিত্র বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কপালে মাহাত্ম্য–তিলক অঙ্কনের এক শিল্পমণ্ডিত প্রয়াস।।
অতীতে ভারত–পাকিস্তান সম্পর্ককে কেন্দ্র করে বলিউডে ‘গাদার’, ‘বর্ডার’, ‘মিশন কাশ্মীর’, ‘কেয়ামত’ সহ যেসব চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে সেখানে পাকিস্তানকে এক শত্র“রাষ্ট্র হিসেবেই চিত্রিত করা হয়েছে। সিনেমাগুলোর ভাষা ছিল আক্রমণাত্মক, খলনায়ক হিসেবে সেখানে উপস্থিত ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্র এবং তার প্রতিনিধিগণ। এই ধরনের চলচ্চিত্র তখন ভারতবাসীর মধ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদের পালে হাওয়ার যোগান দিত বেশ করে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন