সোমবার, ২৭ জুন, ২০১৬

তাবিজ ব্যবহার ইসলামিক দৃষ্টি কোণ থেকে জায়িয, না নায়িজ দলিল ভিত্তিক পর্যালোচনা-পর্ব ১.



👉🍬🍬তাবিজ ব্যবহার ও তার হুকুম - (পর্ব ১)
"""""""""""""""""""""""""""""
তাবিজ বলতে আমরা বাঙ্গালিরা সাধারণত বুঝি একটি কাগজে কিছু তাওহীদি কালাম লিখে সেটিকে গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া। এটি শির্ক কি না এবং শির্ক না হলে জায়েজ কি না এটাই আজকের আলোচনার মূল বিষয়। তাবিজের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করা বা অন্য কোন কারণে এ পোস্ট নয়। বরং তাবিজ নিয়ে কিছু ভাইয়ের তাকফিরি চিন্তার পর্যালোচনার জন্যই এ পোস্ট।
উপরে বর্ণিত তাবিজকে যদি কেউ শির্ক বলে তাহলে আমরা এর ঘোর বিরোধিতা করবো। আমাদের এ বিরোধীতার কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামের হাদীস ও সাহাবায়ে কেরামের কিছু আমল। সামনে এক এক করে আমরা এগুলো আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।

যে তাবিজকে হাদীসে শির্ক বলা হয়েছেঃ
""""""""""""""""""""""""""""""""""""""
এ সংক্রান্ত হাদীস সমূহ থেকে এটা বুঝা যায় যে, জাহেলী যুগে বিভিন্ন অসুস্থতা বালা মুসিবাত ইত্যাদির জন্য শির্কি শব্দ দ্বারা ঝাড় ফুঁক করা্র প্রচলন ছিল। এবং তামাইম গলায় ঝুলিয়ে রেখে তার উপর ভরসা করত। আল্লাহর প্রতি আরোগ্যের বিশ্বাস না রেখে শুধুমাত্র তামাইমের উপর বিশ্বাস রাখত। তারা মনে করত এই তামাইমই তাকে আরোগ্য দান করবে। এজন্য হাদীসে এ তামাইমকেই শির্ক বলা হয়েছে। যার গলদ তর্জমা হল তাবিজ। এ গলদ তরজমার জন্যই যত প্রবলেম ক্রিয়েট হয়েছে। আমরা তামাইম শব্দের অর্থ নিয়ে সামনে আলোচনা করবো। আগে তামাইম শির্ক হওয়ার ব্যাপারে একটি হাদীস দেখে নেই।

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- يَقُولُ ্ إِنَّ الرُّقَى وَالتَّمَائِمَ وَالتِّوَلَةَ شِرْكٌ
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুল সা. কে বলতে শুনেছি যে, নিশ্চয় ঝাড় ফুক করা, তামাইম(রক্ষাকবচ) ব্যবহার করা ও স্বামী বা স্ত্রীকে (ঝাড় ফুঁক বা রক্ষকবচের মাধ্যমে) বশিভুত করা শিরক৷
( আবু দাউদ ৪/১১ হা. ৩৮৮৫ চিকিৎসা অধ্যায়, তাবিজ ঝুলিয়ে রাখা পরিচ্ছেদ।)




হাদীসে বর্ণিত তামিমাতুন(تميمة) শব্দের তাহকীকঃ
"""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""
এক কথায় -
التميمة خرزة رقطاء تنظم في السير ثم يعقد في العنق. –
বিভিন্ন প্রকারের ফিতনা ফাসাদ দূর করতে ব্যবহৃত পুঁথি যা চামড়ার লম্বা টুকরায় বা ফিতায় গাঁথা হয়, অতপর ঘাড়ে বাঁধা হয়৷ অর্থাৎ রক্ষাকবচ৷
( আলমুখাসসিস ফিল লুগাহ 4/21 নৃত্য করা পরিচ্ছেদ৷ আলকামূসুল মুহিত 1/1400 মীম পরিচ্ছেদ, তা অনুচ্ছেদ৷)
আযহারী এর অর্থ সম্পর্কে বলেন- পুঁথি বা সীসার টুকরা, আরববাসীরা তাদের সন্তানদেরকে ঐ পুঁথি বা সীসার টুকরা ঝুলিয়ে দিতেন, যা তাদের বাতিল ধারণা মতে বদ নসরুল বা কুদৃষ্টি থেকে বেচে থাকত৷
( আলমুগরিব ফি তারতীবিল মুরিব 1/245 তা পরিচ্ছেদ, তা ও মীম৷)
সুতরাং تميمة তামীমাতুন অর্থ হলো, বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শিরকযুক্ত ধারণীয় মন্ত্রপূত কবচ, যা আরববাসীরা শিশুদের গলায় দিতেন ও তারা ধারণা করতেন যে, এ রক্ষাকবচ দ্বারা তাদের সন্তানগণ কুদৃষ্টি ইত্যাদি থেকে বেঁচে থাকবে৷

আফসোসের কথা হল এ তামাইমকেই তাবীজ হিসিবে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর এভাবেই হাদীসে তামাইমের ব্যাপারে যে শীর্কের ধমক দেওয়া হয়েছে তা তাবিজের ক্ষেত্রেও চালিয়ে দিচ্ছে। অথচ পোস্টের প্রথমে আমরা যে তাবিজের আলোচনা করেছি তা এবং হাদীসে বর্ণিত তামাইম কখকনই এক না।

তাবিজ ঝুলানোও হাদীস থেকে প্রমাণিত
"""""""""""""""""""""""""""""""""""""""
রাসুল সা. বলেন, তোমাদের মধ্যে কেউ যখন ঘুমাবে তখন বলবে-
أعوذ بكلمات الله التامات من غضبه وعقابه وشر عباده ومن همزات الشيطان وأن يحضرون
তবে তার কোন প্রকার ক্ষতি হবে না।
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. তার প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানকে দুআটি শিক্ষা দিতেন। আর অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তান এর জন্য একটি কাগজে লিখে তার গর্দানে ঝুলিয়ে দিতেন।
ইমাম তিরমিযি রহ. হাদীসটিকে হাসান গরীব বলেছেন।
(তিরমিযি ৫/৪৫১ হা. ৩৫২৮ দাওয়াত অধ্যায়, অনুচ্ছেদ ৯৪। আবু দাউদ ৪/১৮ হা. ৩৮৯৫ চিকিৎসা অধ্যায়, মন্ত্রপড়া অনুচ্ছেদ।)
-----------------------------------------------------------------
উপরে বর্ণিত ইবনে মাসউদ রাযিঃ থেকে বর্ণীত হাদীস থেকে বুঝা যাচ্ছে যে শির্কি কালামযুক্ত বাক্য দ্বারা ঝাড়ফুক করা শির্ক। আবার বহু হাদীস দ্বারা প্রমানিত ঝাড়ফুক করা বৈধ। তবে শর্ত হল তাওহীদি বাক্য দ্বারা ঝাড়ফুক করতে হবে। উদাহারণ হিসেবে একটি হাদীস দেখুন -
হযরত আউফ ইবনে মালেক আশজায়ী রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, জাহেলিয়াতের যুগে আমরা ঝাড় ফুঁক করতাম। আমরা আরজ করলাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! এ সম্পর্কে আপনার অভিমত কি? তিনি বলেন তোমাদের মন্ত্রগুলো আমার সামনে পেশ কর। ঝাড় ফুঁকে যদি শিরকের শব্দ না থাকে তাহলে এতে কোন সমস্যা নেই।
(মুসলিম শরীফ ৭/২৬৮ হা. ৫৫৬৯ কিতাবুস সালাম, পরিচ্ছেদ, বদ নজর, ফুসকুড়ি, ব্রণ, সাপ-বিচ্ছু ইত্যাদির দংশনে ঝাড় ফুঁক করানো উত্তম।)

ঠিক একই ঘটনা তাবিজের ব্যাপারে। হাদীসে তামিমাকে শির্ক বলা হয়েছে ঠিকই কিন্তু কেউ যদি তাওহিদী বাক্য লিখে গলায় ঝুলিয়ে দেয় তাহলে তাতে শির্ক হওয়ার প্রশ্নই উঠে না। তবে সে ক্ষেত্রে অবশ্যই এ আক্বিদা থাকতে হবে যে তাবিজের সমস্যা সমাধান করার কোন ক্ষমতা নেই। যা করেন আল্লাহ।

আল্লামা ইবনে হজর আসকালানী রহ. বুখারী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ ফতহুল বারী তে লিখেন-
وقد أجمع العلماء على جواز الرقي عند اجتماع ثلاثة شروط أن يكون بكلام الله تعالى أو بأسمائه وصفاته وباللسان العربي أو بما يعرف معناه من غيره وأن يعتقد أن الرقية لا تؤثر بذاتها بل بذات الله تعالى
ওলামায়ে কেরাম ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, ঝাড় ফুঁক জায়েয হওয়ার জন্য তিনটি শর্ত বিদ্যমান থাকতে হবে।
১. আল্লাহর কালাম বা তাঁর নাম বা তাঁর গুণাবিশিষ্ট নাম হতে হবে।
২. আরবী ভাষা হতে হবে বা অন্য ভাষা হলে তার অর্থ জানতে হবে।
৩. এবং বিশ্বাস রাখতে হবে যে, ঝাড় ফুঁক তাবিজ ইত্যাদি নিজস্ব কোন প্রভাব ফেলতে পারেনা। বরং আল্লাহ তাআলাই প্রভাব ফেলেন। অর্থাৎ ঝাড় ফুঁক তাবিজ কখনও আরোগ্য দিতে পারেনা। বরং আরোগ্যদানকারী স্বয়ং আল্লাহ তাআলাই।
ফতহুল বারী ১০/১৯৫

তাবিজের ক্ষেত্রেও ঠিক একই শর্ত মেনে চললে তা বৈধ। কারণ যে কারণে ঝাড়ফুককে শির্ক বলা হয়েছে সে কারণে তাবিজকেও শির্ক বলা হয়েছে। একই ভাবে হাদীসে ঝাড়ফুকের যেমন বৈধ পন্থা রয়েছে ঠিক তিমনি ভাবে তাবিজের বৈধ পন্থা রয়েছে। ঝাড়ফুক আর তাবিজের মধ্যে পার্থক্য শুধু এতটুকু যে ঝাড়ফুকের সময় কলেমাগুলো মুখে উচ্চারণ করা হয় আর তাবিজের ক্ষেত্রে এগুলো কাগজে লিখে দেওয়া হয়।

সুতরাং শরীয়তের আলোকে ঝাড় ফুঁক তাবিজ ইত্যাদিতে উপরের শর্ত বিদ্যমান থাকলে আর্থাৎ শিরক জাতীয় কিছু না থাকলে এবং উহার উপর ভরসা না থাকলে ঝাড় ফুঁক ও তাবিজ ব্যবহার করা জায়েয হবে। এতে কোন প্রকার সমস্যা নেই। এমনকি শিরক বা হারামও নয়। যারা এমন (শিরক বা হারাম) বলে থাকে তাদের কথা সঠিক নয়।
আল্লাহ সকলকে বুঝার তাওফীক দান করুন। আমীন।

[ চলবে ইনশাআল্লাহ ]


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন